মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ১০:০৮ অপরাহ্ন

এমএলএম এখন অনলাইনে ৩শ কোটি টাকা নিয়ে উধাও সাত কোম্পানি

এমএলএম এখন অনলাইনে ৩শ কোটি টাকা নিয়ে উধাও সাত কোম্পানি

স্বদেশ ডেস্ক:

চটকদার অফার, নিবন্ধন করলেই বেকারত্ব শেষ। এরপর বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখা, লাইক দেওয়া আর অন্যকে কোম্পানির সদস্য হিসেবে নিবন্ধন করতে পারলেই মিলবে টাকা। প্রথম দিকে নিবন্ধন ফি কম থাকলেও বিশ^স্ততা অর্জনের পর বড় অঙ্কের অফার ঘোষণা করা হয়। বেশি লাভের আশায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন সদস্যরা। কোনো কোনো গ্রাহকের ১০টিরও বেশি নিবন্ধন আইডি রয়েছে। পাঁচশ টাকা থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন প্রায় ১২ লাখ গ্রাহক। বিপুল অঙ্কের টাকা নেওয়ার পরই ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইটসহ সবকিছু স্থায়ীভাবে বন্ধ করে লাপাত্তা হয় এসব কোম্পানি। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহেই অন্তত ৭টি কোম্পানি বিপুলসংখ্যক গ্রাহকের প্রায় তিনশ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। প্রতারণার শিকারদের বেশিরভাগই কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। লকডাউনের মধ্যে কিছুটা আয়ের আশায় এসব অনলাইন এমএলএম কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে ভুক্তভোগীরা এখন হা-হুতাশ করছেন।

ইনসাফ সেভেন কোম্পানির মালিক হাসান মাহমুদ। পরিচিত রাকিব উদ্দিন মোড়ল নামেও। গত আট মাসে কোম্পানিটিতে বিনিয়োগ করেছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ বিনিয়োগকারী। তিনটি ওয়েবসাইট, বেশকিছু ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ খুলে প্রচার চালানো হয় কোম্পানির। দুই হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকার প্যাকেজ রয়েছে। একেকজন গ্রাহকের একাধিক অ্যাকাউন্টও রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতারিত গ্রাহকরা বলছেন,

ইনসাফে প্রায় ১১ লাখ অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সব মিলিয়ে ইনসাফ সেভেন প্রায় ৮০ কোটি টাকা নিয়েছে গ্রাহকদের থেকে। এ বিষয়ে ইনসাফ সেভেনের মালিক হাসান মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপ ও ইমো চালু থাকলেও কল রিসিভ করেননি তিনি। গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে প্রায় ১১ লাখ বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে কোম্পানির কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছেন- এমন প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।

গ্রাহকরা জানান, কোম্পানির বিশ^স্ততা অর্জনের জন্য মালিক হাসান মাহমুদ মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া ইউনিয়ন থেকে নেওয়া একটি ট্রেড লাইসেন্সের কপি প্রচার করেন। টিন নম্বরসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস দেখাতেন গ্রাহকদের। তবে ওই লাইসেন্সটি ভুয়া বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে হাসাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোলায়মান খান আমাদের সময়কে বলেন, এ নামে কোনো ব্যক্তিকে চিনি না। লাইসেন্সটিও ভুয়া। প্রতারক ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। হাসাড়া ইউনিয়নের নাম ব্যবহার করলেও চেয়ারম্যানের সই ও স্বাক্ষর ভোলা জেলার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের।

ইনসাফ সেভেনে বিনিয়োগ করেছেন লতিফুল ইসলাম নামের একজন শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, কলেজ বন্ধ, কাজ নেই। তাই নানা অফারে প্রলুব্ধ হয়ে ইনসাফ সেভেনে বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু এখন কোম্পানি বন্ধ। নানা জায়গায় খুঁজেও কাউকে পাচ্ছি না। আমরা টাকা ফেরত চাই। ইনসাফ সেভেনের মালিকদের শাস্তি চাই।

গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকা থেকে ই-কমার্সের নামে যাত্রা শুরু করে এমএলএম কোম্পানি এসপিসি ওয়ার্ল্ড এক্সপ্রেস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে রয়েছে আল আমিন প্রধান। তিনি ডেসটিনি ২০০০-এর একজন উচ্চপর্যায়ের টিম লিডার ও প্রশিক্ষক ছিলেন। সেখানে তার যেসব সহযোগী ছিলেন তাদের নিয়েই ভিন্ন কৌশলে মাঠে নামেন আল আমিন। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর মাত্র ১১ মাসে তার ঝুলিতে জমা হয় ২৬৮ কোটি টাকা। এমএলএম ব্যবসা ও প্রতারণার দায়ে ৩ ফেব্রুয়ারি আল আমিনসহ প্রতিষ্ঠানটির ছয়জন গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ওই ঘটনায় মামলা হয় এবং গ্রেপ্তারদের কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু দুই মাসের ব্যবধানে জামিনে বের হয়ে আবারও এসপিসির কার্যক্রম শুরু করেন আল আমিন প্রধান।

জানা যায়, বর্তমানে পঞ্চাশ লাখের বেশি নিবন্ধনকারী রয়েছে এসপিসির। প্রতি অ্যাকাউন্ট বাবদ এসপিসিকে দিতে হয় ১২শ টাকা। এরপর বলা হয়- প্রতিদিন ২০ সেকেন্ড করে ওয়েবসাইট ভিজিট করলেই গ্রাহক পাবেন ১০ টাকা। এরপর তিনজনকে যুক্ত করতে পারলেই মিলবে অতিরিক্ত টাকা। এ ক্ষেত্রে একজনকে যুক্ত করলে স্পন্সর বোনাস ৪০০ টাকা। এসপিসির বেশ কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চারদিন ধরে এসপিসির কোনো এজেন্ট বা গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। কেউ পাওনা টাকাও তুলতে পারছেন না। এসপিসি গ্রাহকদের ফেসবুক গ্রুপ এসপিসি অনলাইন বিজনেস অ্যান্ড হেল্প গ্রুপেও দেখা যায় গ্রাহকদের হাহাকার। তারা বলছেন, শত কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নিয়ে এমএলএম ব্যবসা বন্ধ করেছে এসপিসি। কোম্পানিটির নির্বাহী আল আমিন প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। বন্ধ রয়েছে তার মোবাইল ফোনও।

কেবল ইনসাফ, এসপিসিই নয়- প্রতারণার জাল বুনেছিল আরও কয়েকটি কোম্পানি। বেকারত্বের সুযোগ নিয়ে এরা সাধারণ মানুষের থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ টাকা। চলতি সপ্তাহেই লাপাত্তা হয়েছে টু-লাইক নামের একটি অনলাইন এমএলএম কোম্পানি। ৩০ হাজারের বেশি বিনিয়োগকারীর টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছে তারা। বিনিয়োগকারীরা জানান, ২০ ডলার থেকে শুরু করে ৫ হাজার ডলারের প্যাকেজ রয়েছে টু-লাইকের। এ ক্ষেত্রে প্রথমদিকে অল্প বিনিয়োগে বেশি লাভ দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হয়। এরপর বড় অফারের মাধ্যমে গ্রাহকদের থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে চম্পট দেয় প্রতিষ্ঠানটি। দেশে এটির ব্র্যান্ডিং করেছেন বেশ কয়েকজন ইউটিউবার।

গোল্ডরাশ নামের একটি অনলাইন এমএলএম কোম্পানিও বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে। গ্রাহকরা জানিয়েছেন, গোল্ডরাশের নিবন্ধিত সদস্য প্রায় ৬০ হাজার। মাস দুয়েক আগে মাঠে নামে গোল্ডরাশ। এ কাজে শুরুর দিক থেকেই নেতৃত্ব দেন শোভন প্রিন্স নামের একজন ইউটিউবার। তাদের ইউটিউব চ্যানেলের নাম ইনকাম বাংলা। মূলত তিনিই দেশে গোল্ডরাশের প্রচার চালাতেন। মাত্র ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০০ টাকা পর্যন্ত অফারের বিপরীতে গ্রাহকদের নানা লাভ দেওয়া হতো। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখানো বাবদ আয়ের কথা বলা হলেও মূলত ফাঁদ পাতা হয়। সম্প্রতি গোল্ডরাশ ৩০ ভাগ ছাড় দিয়ে ৩০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত প্যাকেজের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এরপর হুমড়ি খেয়ে পড়েন গ্রাহকরা। প্রায় ৬০ হাজার গ্রাহকের টাকা নিয়ে হঠাৎ সব ধরনের সেবা বন্ধ করে দেয় তারা। একই সময়ে উধাও হয়ে যায় গোল্ড লাইন নামের আরেক প্রতিষ্ঠানও। এটির গ্রাহক ছিল ৩০ হাজারের মতো।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিন্দাসওয়ার্ক ডটকম নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানও গ্রাহকদের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। এটির গ্রাহকরা জানান, প্রায় ৬০ হাজারের বেশি গ্রাহক রয়েছে তাদের। ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন একেকজন গ্রাহক। এ ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়েছে লোভনীয় অফারের সুযোগ। শুরুতে ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকার অফারে বিপুল লভ্যাংশ দিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়। এরপর বড় অফার দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে নিয়ে ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক পেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়।

অভিযোগ নিয়ে ভুক্তভোগীরা বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও সুরাহা হয়নি। সোহানুর রহমান নামের একজন গ্রাহক বলেন, আমাদের মিথ্যা আশ^াস দিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে পালিয়েছে বিন্দাসওয়ার্ক। আমরা সিআইডি বরাবর অভিযোগ দিয়েছি। তিনি বলেন, প্রায় ৬০ কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ইউপিডি ক্যাশ নামের একটি অনলাইন এমএলএম কোম্পানিও ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহকের অর্থ নিয়ে চম্পট দিয়েছে। তারা মূলত বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে অর্থ নিত গ্রাহকদের থেকে। চলতি সপ্তাহে বন্ধ হয়ে যায় কোম্পানির সব যোগাযোগের নম্বর। যেসব অ্যাকাউন্টে টাকা নেওয়া হতো, তাও বন্ধ। রাকিবুল ইসলাম সাকিব নামের একজন বিনিয়োগকারী বলেন, অনলাইনে আয়ের জন্য বিনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু কোম্পানিটি হঠাৎ উধাও। পরিচিত অনেকেই এখানে বিনিয়োগ করেছিল। এখন কোনোভাবেই ইউপিডির হদিস পাচ্ছি না।

শুধু এসব প্রতিষ্ঠানই নয়, গত এক বছরে অনেক অনলাইন এমএলএম কোম্পানি এভাবে প্রতারণা করেছে। বর্তমানে এমন অর্ধশতাধিক কোম্পানি নানা উপায়ে প্রচার চালিয়ে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করছে। বিডি লাইক, ইফোর্ডবিডি, জিওনেস, লাইক এইচএমপি ওয়ার্ল্ড, টু-লাইক ওয়েব, বিডি ক্যাশ রিওয়ার্ডস, স্টারস ফেয়ার২৫.কম, ওয়ালমার্ট গ্রুপ, জিএসসিবিডি, ইউকে লাইকসহ আরও অনেক কোম্পানি সক্রিয়।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার রেজাউল মাহমুদ আমাদের সময়কে বলেন, আমরা বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি। এর বাইরে নিজস্ব মনিটরিংয়েও কিছু বিষয় নজরে এসেছে। স্কুল, কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতারক চক্র সুযোগ নিচ্ছে। তবে আমরা নিয়মের বাইরে গেলেই ব্যবস্থা নেব। প্রশাসন মনিটরিং করছে, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ আমাদের সময়কে বলেন, ফেসবুকসহ বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে ব্যবসা করতে ব্যবসার পরিকল্পনা জমা দিয়ে নিবন্ধন নিতে হবে। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবসা করতে গেলে অবশ্যই নিবন্ধন নিতে হবে। যারা কেবল ফেসবুকে ব্যবসা করবেন তাদেরও ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সেন্ট্রাল নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখব। সেখান থেকে ইউনিক বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নম্বর নিতে হবে প্রত্যেককে। রেজিস্ট্রেশন ছাড়া যে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে তা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আমরা বিটিআরসিকে অনুরোধ করব।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877